• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ০৫:২৭ পিএম
শব্দহীন বার্তা দিয়ে গেছে গোটা জাতি      
জুলাই আন্দোলন

 এম আর ইসলাম

দেশে গত দুই দশকে একশ্রেণির জ্ঞানপাপী সৃষ্টি হয়েছে, যারা ব্যক্তিস্বার্থে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে বা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে বয়ান তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত। তাদের ঘটনার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা আমাদের বিভ্রান্ত করে। তবে, ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক নির্মোহ আলোচনার দাবি রাখে। আপাতদৃষ্টিতে, এই আন্দোলন সময়ের ব্যাপ্তিতে সংক্ষিপ্ত হলেও এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী ও বৈচিত্র্যময়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এ দেশের নষ্ট রাজনীতি। এ দেশের মানুষ কোনও সরকারের কাছ থেকে খুব বেশি সামাজিক বা অর্থনৈতিক সুরক্ষা আশা করে না; অথচ এরা দেখেছে রাজনৈতিক সরকারেরা শুধু একশ্রেণির মানুষকে সুরক্ষা দিতে চায়। যারা রাজনীতির জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। এমনটা দেখা গেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। রাজনীতির বিশেষ মহলগুলো বিশেষ মানুষদের ভাগ্য বদলেছে, দেশের মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে। এই যাবতীয় অনাচারের কোনও জবাবদিহি ছিল না।

২০২৪-এর জুলাই এর ছাত্র আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী প্রতিবাদ হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। এই আন্দোলনের শৌর্য যদিও প্রকাশ পেয়েছে রাজপথে, কিন্তু এই আন্দোলনের চেতনা দেশের আপামর মানুষ ধারণ করেছে বহুদিন ধরে তার অস্থিমজ্জায় যদিও তা পূর্বে কোনও সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি। এই আন্দোলন যদি শুধু ছাত্রদের সরকারি চাকরির বাজারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে হবে, তবে এই আন্দোলন কেন সর্বজনীন রূপ নিলো? কেন সর্বস্তরের মানুষ পরোক্ষ আর প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনকে আপন করে নিলো। খাবার, পানি নিয়ে কেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা রাজপথে নেমে এলো? কেন মানুষ প্রার্থনায় রত হলো এই আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য? কেন ৯ দফা থেকে ১ দফায় পরিণত হলো? এই উত্তরগুলো মিলবে তখনই, যখনই এই আন্দোলনকে দেখা হবে এক নিপীড়ন, বঞ্চনা আর অবিচারবিরোধী সংগ্রাম হিসেবে।

এই আন্দোলন ‘অভ্যুত্থান’ নাকি ‘বিপ্লব’, তা নিয়ে যথেষ্ট তাত্ত্বিক গবেষণা, তর্ক জারি আছে। কেউ বলতে চায়, এটা ‘গণঅভ্যুত্থান’ কারণ প্রায় সর্বস্তরের মানুষের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক শরিকানা এখানে ছিল বিভিন্নভাবে। কারণ ভিন্ন থাকলেও উদ্দেশ্য ছিল এক, যেমন একটা অগণতান্ত্রিক, জনবিচ্ছিন্ন সরকারকে হটানো। অন্যদিকে, যারা এটাকে বিপ্লব বলে আখ্যা দিতে চান, তারা দেখেন এই আন্দোলন কোনও বিশেষ এলাকায় বা বিশেষ সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটা মানুষের মনোজগৎকে নাড়া দিয়েছিল সার্বিকভাবে, অন্যায়কে রুখে দিতে প্রেরণা জুগিয়েছিল, প্রতিবাদী মানুষকে রাজপথে এনেছিল, ঢিল আর গুলতি নিয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করানোর সাহস জুগিয়েছিল। আন্দোলনকারীরা একের পর এক তাদের পদ্ধতি পাল্টাচ্ছিল, যাবতীয় রাষ্ট্রশক্তির সামনে এরা ছিল অকুতোভয়। মৃত্যুকে তুচ্ছ ভাবতে শেখা শুধু বিপ্লবেই দেখা যায়। দেশের তরুণ ছাত্ররা যখন সরকারি বাহিনীর গুলিকে বুকে ধারণ করার সাহস দেখাচ্ছিল, তখন তাকে আর বৈপ্লবিক না ভাবার কোনও কারণ দেখি না। এই আঙ্গিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ‘বিপ্লব’ বৈকি। এই লেখা মূলত এই আন্দোলনকে বিপ্লব হিসেবে দেখে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলেও এর বিপ্লবী পরিভাষা ছিল সরকারের একচেটিয়া অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে। ‘বৈষম্য’ যখন নগ্ন আকারে সর্বজনীন হয়ে পড়ে, তখন তা হয়ে যায় নিপীড়ন, দুঃশাসন। পরীক্ষিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কখনও কখনও কৌশলে বৈষম্য তৈরি করা হয়; যায় মূলত করা হয় সূক্ষ্মভাবে। ধরা যাক, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এমন কোনও শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো, যখন তা বিশেষ কোনও বর্ণের বা এলাকার শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয় বা কোনও গোষ্ঠীকে অসুবিধায় ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে একটা অগণতান্ত্রিক সরকার যখন প্রকাশ্যে একটা বিশেষ এলাকার, বিশেষ রাজনৈতিক ঘরানার মানুষদের নগ্নভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়, চাকরি ও ব্যবসা তাদের হাতে তুলে দেয়, তখন আর তা বৈষম্য থাকে না, হয়ে যায় স্পষ্ট দুঃশাসন। এই দুঃশাসন যাবতীয় সীমা লঙ্ঘন করে তখন, যখন বছরের পর বছর নির্লজ্জভাবে একই ধারা চলে, আর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব যখন প্রকাশ্যে অন্য দেশের কাছে ইজারা দেওয়া হয়, তখন দেশ ও দেশের মানুষের অস্তিত্ব যাবতীয়ভাবে অনিরাপদ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে যখন নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়, তখন জনক্ষোভ বিপ্লবে পরিণত হয়।               

তাই, চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী দাবির পক্ষে ছাত্রদের যে প্রতিবাদ তা ছিল মূলত ‘টিপ অব আইসবার্গ’। বিগত দুই দশকে সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিল এ দেশের রাজনৈতিক সরকারেরা তাদের ঠকায়; এরা মূলত একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করতে সরকারে যেতে বা থাকতে মরিয়া; এরা সরকারি প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ হাতিয়ে নেয়।

রাজনৈতিক সরকারগুলোর ওপর মানুষের এই বিশ্বাস একবারে উঠে গেলো তখন, যখন মানুষ দেখলো জনগণের ম্যান্ডেটকে থোড়ায় কেয়ার করে কোনও ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যায়; ভোটের নামে পুলিশ আর সরকারি লোক দিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনেও ব্যালট বাক্স ভরা যায়। দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে দেউলিয়া করে দিতে রাষ্ট্রের কর্তাদের বুক কাঁপে না।  

এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দিক তরুণ সমাজের রাষ্ট্রচিন্তা ও হাল না ছাড়ার মানসিকতা। ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সব শ্রেণি থেকে উঠে আসা যুবসমাজ যাদের কেউ সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে পড়ে, আবার কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত, এমন সবাই এককাতারে এসে লড়েছে এই জনযুদ্ধে। এমন অভূতপূর্ব মিলন কে দেখেছে কবে? এই পুঁজিবাদী, ভোগী সমাজে ছাত্র-জনতার এমন গণ-অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।

এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বহুমাত্রিক বা বিবিধ। ছাত্র-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হলেও এর প্রেক্ষাপট নির্মাণে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকা ছিল। অগণতান্ত্রিক আর আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো সম্প্রতি বিতাড়িত সরকারের জনভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ খুব বেশি জমে ওঠেনি। স্বার্থহীন, দুঃসাহসী সংগ্রামীর অভাব তাদের ছিল। সরকার তার পেটুয়া বাহিনীদের দিয়ে বিরোধী শিবিরের আন্দোলনকে শক্তহাতে দমন করতে তাই খুব বেশি বেগ পায়নি। তবে এটা ঠিক যে বহুদিন ধরে এ দেশে বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো খুব বেশি একটা সাফল্য পায় না এর জনসম্পৃক্ততার অভাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি সচেতন বা শিক্ষিত জনগণের বিশ্বাসহীনতা দেখা যায়। তাই তো সংগ্রাম পরবর্তীকালে এ দেশের বিজয়ী তরুণ তুর্কিরা চায় নষ্ট, দুর্নীতিবাজ আর দলীয় দালালমুক্ত সিস্টেম। তাদের দাবি, শুধু দলীয় সরকার পরিবর্তন না, বরং ভঙ্গুর সিস্টেমকে ঢেলে সাজানো।      

এই আন্দোলন এমন সময় দানা বাঁধলো যখন দেখা গেলো সরকারের প্রভাবশালী নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিতে একের পর এক রেকর্ড ভাঙছিল। দেশের মানুষ দিন চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি যখন হারাচ্ছিল, তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সরকার আর সরকারের পার্টনারশিপে আমলা ও ব্যবসায়ীরা কীভাবে দেশকে দেউলিয়া করে, নিজেদের অর্থেবিত্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। শেয়ার বাজার লুট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরি, লক্ষ কোটি টাকা প্রতিবছর পাচার করা, কুইক রেন্টাল দিয়ে টাকা পাচার, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডি ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে মেগা দুর্নীতি মানুষকে হতবিহ্বল যখন করেছিল, তখনও সরকার এ দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ না করে, নিজেদের খেয়াল জারি রেখে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে প্রতিজ্ঞ ছিল।

তাই নির্দলীয় আন্দোলন হিসেবে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে সব মানুষ গ্রহণ করেছিল। নিজেদের আন্দোলন হিসেবে সাধারণ জনগণ মেনে নিয়েছিল। তাই তো, আর কোনও দানবীয় শক্তি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। জনঐক্য ও সমর্থন চূড়ান্ত সাফল্যের সহায়ক হলো। তবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অসহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ও কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সের ক্রমাগত রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মানুষকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে সাংঘাতিকভাবে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন দালালির মিথ্যা বয়ান বানাতে ব্যস্ত, তখন কিছু মানুষ দেশ ও দেশের বাইরে থেকে তাদের প্রচারণা অব্যাহত রাখে। কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্বের আহ্বান নয়, কিন্তু তরুণ ছাত্রদের নিবেদিত ত্যাগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচার এক শব্দহীন বার্তা দিয়ে গেছে গোটা জাতিকে।          

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ

আরো পড়ুন

banner image
banner image