মোঃ নজরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ : আমাদের সমৃদ্ধ লোক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হিরন্ময় স্মারক মৈমনসিংহ গীতিকা ১৯২৩-২০২৩ প্রকাশনার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টায় ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তাফিজার রহমান।
অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে স্মারক বক্তৃতা, শতবর্ষ স্মরণে জলদ প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন, কথোপকথন, উৎসব পিঠা ভাগাভাগি, মিষ্টান্ন মুখ, গীতিকা থেকে উপস্থাপন ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক গান, মৈমনসিংহ গীতিকা'র তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, অনসাম্বল প্রযোজনা ৩৩: 'কিচ্চাপালা- মহুয়া সুন্দরীর পালা পরিবেশন করা হবে।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের সাহিত্যগাথা প্রেম-প্রণয় ও প্রাণ বিসর্জনের বিরহগাথার নাম মৈমনসিংহ গীতিকা। অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ জেলা ছিল ময়মনসিংহ। একসময় একে নাসিরাবাদ ও মোমেনশাহীও বলা হতো।
ময়মনসিংহের মানুষের দুঃখ-বেদনা ও বন্দনার গান সব জায়গায় ধ্বনিত হতো। এজন্য ময়মনসিংহ জেলার নামেই এ মৈমনসিংহ গীতিকা। এ বছর মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের ১০০ বছর পূর্ণ হলো।
তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের জনক, প্রাচীন পুঁথি ও পল্লী সাহিত্য সংগ্রাহক ও প্রকাশক অধ্যাপক ড. দীনেশচন্দ্র সেনের নিরলস পৃষ্ঠপোষকতায় নেত্রকোনার চন্দ্র কুমার দে ১০টি পালা সংগ্রহ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকার এ পালাগুলোর ঘটনাপরম্পরা চন্দ্র কুমার দে নেত্রকোনা, সুসাঙ-দুর্গাপুর, গাড়ো পাহাড়, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর ও কেন্দুয়ার বিভিন্ন পল্লীগ্রামে ঘুরে ঘুরে লোকশ্রুতি হিসাবে বিভিন্ন বর্ষীয়ান পালাকার, বয়াতি, গায়ক, মাঝিমাল্লার কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। এরপর পালাগুলো ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নামে ১৯২৩ সালে বাংলা ও ইংরেজিতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন। পরবর্তীকালে চার খণ্ডে ৫৪টি পালা মুদ্রিত হয় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে।
মৈমনসিংহ গীতিকা ১৯২৩ সালে প্রকাশের পর এর পালা বা গাথার কাহিনি ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষের সাহিত্য-সুধীজনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সারা বিশ্বে এমন মহতী লোকগান ও গাথা তুলে ধরার জন্য ড. দীনেশচন্দ্র সেনও বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। মহুয়া পালার বেদের মেয়ে, ষোল বছরের সুন্দরী মহুয়া ও ব্রাহ্মণকুলের নদেরচাঁদ, মলুয়ার মলুয়া ও চাঁদ বিনোদ, দেওয়ান মদিনার মদিনা-দুলাল, দেওয়ান ভাবনার সুনাই-মাধব, কাজলরেখার রাজপুত্র-সবার প্রেম-বিরহ-আত্মবিসর্জনের কাহিনি শুনে ব্রহ্মপুত্র, কংস, ধনু, আড়িয়ালখাঁ, মেঘনা, ফুলেশ্বরী, নরসুন্দা, সূতা নদী এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের হাওড়-বাঁওড়ের আকাশ-বাতাস বিষণ্ন-ব্যথিত হয়ে উঠত।
দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত মৈমনসিংহ গীতিকা আর তার ইংরেজি তরজমা ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস ১ম খণ্ড—দুটি বই–ই প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। বরং মূল বইটি প্রকাশের আগেই বের হয় তরজমাটি। প্রকাশের পরপরই এটি দেশি-বিদেশি সাহিত্যিক মহলে আলোড়ন তোলে। বাংলা লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারের পরিচয় পেয়ে সবাই বিস্মিত হন। প্রকাশের শতবর্ষ উপলক্ষে দেখা দরকার, কোন বিস্ময়কর উপাদান এ বইয়ে আছে, যা আমাদের জাতীয় মানসকে নিবিড়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।
১৯১৩–৩২ কালপর্বে দীনেশচন্দ্র সেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপের অধীনে চার খণ্ডে পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা সম্পাদনা করেন। এরই ১ম খণ্ড মৈমনসিংহ গীতিকা।
১৯১৩ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সৌরভ পত্রিকায় পূর্ব বাংলার কয়েকটি গীতিকার অংশবিশেষ এবং সে সম্পর্কে চন্দ্রকুমার দের প্রবন্ধ পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন এর প্রতি আকৃষ্ট হন। গীতিকা সংগ্রহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক চন্দ্রকুমার দের নিযুক্তির ব্যবস্থা করেন। পরে একই কাজে নিযুক্ত করেন আশুতোষ চৌধুরী, নগেন্দ্রচন্দ্র দে ও কবি জসীমউদ্দীনকে। এঁদের মাধ্যমে ময়মনসিংহসহ বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৫৪টি গাথা সংগৃহীত হয়। যেগুলো তিনি পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকায় সংকলন করেন। একই সঙ্গে বের করেন এর ইংরেজি তরজমা, চার খণ্ডে ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস। এসব গীতিকার প্রতি তাঁর আগ্রহকে সুনজরে দেখেননি কলকাতার অভিজাতশ্রেণির কিছু ব্যক্তি।
ফরাসি পণ্ডিত হগম্যান বলেছেন, ফরাসি সাহিত্যের তুলনায় বাংলার পল্লীগাথার সোন্দর্য সর্বকাল স্থায়ী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মৈমনসিংহ গীতিকা বাংলা পল্লী হদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বতঃউচ্ছ্বসিত অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি। একই লেখায় ড. দীনেশচন্দ্র সেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে কবিগুরু বলেন, এই আবিষ্কারের জন্য আপনি ধন্য।
শতাব্দী সমান মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো যদি নতুন প্রজন্ম পড়ে, তাহলে বুঝতে পারবে শত বছর আগের প্রান্তিক জনমানুষ দুঃখে-কষ্টে-কামনায় কতটা অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক ছিল।
অনসাম্বল থিয়েটারের সভাপতি নাট্যজন মো: আবুল মনসুর জানান জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা-২০২৩ প্রাপ্তি ও গীতিকার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এ মাসের শুরু থেকে মাসব্যাপী গীতিকার তথ্যচিত্র ও সংগঠনের মঞ্চায়িত বিভিন্ন নাটকের পোষ্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
অনারম্মর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পোস্টার প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন ময়মনসিংহের বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া।
শহরের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল বিভিন্ন স্থানে এই প্রদর্শনী করা হয়েছে।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: