নিজস্ব প্রতিবেদক :
১৯৫৫ সালের জুলাই মাস। রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে তাঁর শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকদের কথা “লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই”। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমত রাজনীতি প্রভাবিত এবং মার্কসবাদের অনুসারী। চোখে তাঁর বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই তিনি ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ালেন। জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। আর সেই সঙ্গে শুরু হল তাঁর জীবন সংগ্রাম।
ঢাকায় এসে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে দৈনিক 'মিল্লাত' পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। হাতেখড়ি হল সাংবাদিকতায়। সেই থেকে তাঁর কলমের আঁচড়ে তৈরি হতে লাগল এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও পারিবারিক নাম তাঁর আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। তাঁদের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাঁদের বাড়িঘর জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তাঁরা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আর এই খান সনতলা গ্রামেই ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন ১১ আষাঢ় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন।
মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁকে কলকাতায় নিঃসন্তান ফুফু সালেমা খানমের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় দুর্যোগের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। কিশোর কামাল লোহানী শিশু বিদ্যাপীঠে গেছেন কানে তুলো দিয়ে। যদি বোমা ফাটে ঘর থেকেই এ সতর্কতা। জাপানী বোমার ভয়ে বালির দেয়াল তৈরি করা আছে স্কুল প্রাঙ্গণে, সাইরেন বাজলেই ছুটে যেতে হবে ঐখানে, ওটা ছিল স্কুলের নির্দেশ। মানুষের সৃষ্ট যুদ্ধ, মন্বন্তর, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা আর দেশ বিভাগের উন্মাদনার মধ্য দিয়ে তার সময় কাটে।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে এলেন। পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ছোট কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক হোসেন খান লোহানীর কাছে থেকে পড়াশুনা করেন। ৫২'র ২১ ফেব্রæয়ারির রক্তাক্ত রাজপথ, তখন বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর আর দাঙ্গা দেখা তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এই কিশোর ছুটে বেরিয়ে এলেন, কণ্ঠ উচ্চকিত করলেন মিছিলে, হত্যার প্রতিবাদে। রাজনীতিতে সবক নিলেন তিনি ঐ বায়ান্নর একুশ, বাইশ আর তেইশে ফেব্রæয়ারির রক্তধোয়া দিনগুলোর সংঘাতে।
১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যখন কলেজ নির্বাচন এগিয়ে এলো তখন তাঁরা ক'জন সমমনা একজোট হয়ে বাঁধলেন জোট, নাম দিলেন 'পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট' অর্থাৎ প্রগতিবাদী ছাত্র জোট। লড়লেন নির্বাচনে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এই কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলনে যোগদান এবং বারবার কারাবরণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। সেসময়ে তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপশি সাংস্কৃতিক সংগ্রমেও সক্রিয় ছিলেন।
১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এইখানে যোগদানের জন্য আসেন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খুনী নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব নিশতার, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাউয়ুম খান, প্রাদেশিক লীগ নেতা মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকারী নূরুল আমিনের পাবনা আগমন ও মুসলিম লীগ সম্মেলনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কামাল লোহানী পাবনার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথমবারের মত গ্রেফতার হলেন। ৭ দিন পাবনা জেলে আটক থেকে জামিনে মুক্তি পান।
১৯৫৪ সালের মার্চে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন। কামাল লোহানী তথা সকল প্রগতিশীল ছাত্ররাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে গণজমায়েত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরদিন ২২-ফেব্রুয়ারি সকালে কামাল লোহানী গ্রেফতার হন এবং যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে নির্বাচনের পর মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু মার্কিনী মদদপুষ্ট পাকিস্তান সরকার এই বিজয়কে গ্রহণ করেনি। এবং শঙ্কিত হয়ে ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরী শাসন’ চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন। কলেজ ছুটি থাকায় কামাল লোহানী গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানে থেকে ১লা জুন পুনরায় গ্রেফতার হন। উল্লাপাড়া থানা হাজতে দিনভর থাকার পর রাতে তাঁকে পুলিশ পাহারায় পাবনা ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঈদের দিন পাবনা জেলে 'রাজবন্দি' হিসেবে কারাজীবন শুরু করেন কিন্তু কিছুদিন পর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তিনি।
১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাপ-এ যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে, কামাল লোহানী আত্মগোপন করতে বাধ্য হলেন। কিছুদিন পর গ্রেফতারীর শঙ্কা কেটে গেলে আবার কাগজে যোগ দেন এবং নৃত্যগুরু জি.এ. মান্নানের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। দৈনিক পত্রিকায় তা প্রকাশ করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নৃত্য অধ্যায়। এসময় বুলবুল একাডেমিতে জি. এ. মান্নান যখন 'নক্সী কাঁথার মাঠ' প্রযোজনা করলেন, তখন ছেলে চরিত্রে অংশ নিলেন কামাল লোহানী। ১৯৫৯ সালে এই নৃত্যনাট্য নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন তিনি। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং ইরান, ইরাক সফর করেন।
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী তাঁরই চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন। দীপ্তি তখন সমাজল্যাণে মাষ্টার্স করছিলেন। জীবিকার চাপ শুরু হল। কামাল লোহানী বনেদী সংবাদপত্র ‘ দৈনিক আজাদ’-এ যোগ দিলেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় শুরু হলো তোড়জোড়, কামাল লোহানী যুক্ত হলেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সাংগঠনিক কাজে। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে “শ্যামা” নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে নন্দিত হলেন। ষাটের দশকে পÐিত বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত “মিউজিক কলেজ” এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত না থাকলেও এর প্রতিটি কাজে তিনি যুক্ত থেকে বারীণ মজুমদারকে সর্বতো সমর্থন ও সহায়তা করে গেছেন আশির দশক পর্যন্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পন্ডিত বারীণ মজুমদারের একক প্রচেষ্টায় ইঙ্গিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত “প্রথম পাকিস্তান সঙ্গীত সম্মেলন” এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত “আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলন” এ কামাল লোহানী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, শিল্পী সংগ্রহ, উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন দায়িত্বে সম্পৃক্ত থেকেছেন।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠলো। কামাল লোহানীর নামে জারি হল হুলিয়া। ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রথম সন্তান সাগরের জন্ম হল ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি। আর ঐদিনই গ্রেফতার হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হল। ১৩ ফেব্রæয়ারি গভীর রাতে ‘দৈনিক আজাদ’ থেকে ঘরে ফেরার পথে গ্রেফতার হলেন তিনি। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, রণেশ দাশগুপ্ত, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁ, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসাথে ছিলেন। এ সময় ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ মনি, হায়দার আকবর খান রনো, শ্রমিকনেতা নাসিম আলীও ছিলেন। সাড়ে তিন মাস পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক 'সংবাদ'-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে অল্প দিনেই শিফট-ইন-চার্জ পদে উন্নীত হন। ১৯৬৬ সালে ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেটে’ এবং ১৯৬৯ এর প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্যে ‘দৈনিক পয়গাম’ এ যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের শেষ ভাগে কামাল লোহানী অবজারভার গ্রæপ অব পাবলিকেশন্সের 'দৈনিক পূর্বদেশ' পত্রিকায় শিফট ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। পরে চীফ সাব-এডিটর পদে উন্নীত হন। এই সময়ে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী 'ছায়ানট' সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। নীতিগত কারণে ছায়ানট ছেড়ে মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন 'ক্রান্তি'। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্বোধন হয় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আয়োজন করেন গণসংগীতের অনুষ্ঠান "ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে"। নাটক "আলোর পথযাত্রী" পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন এবং নৃত্যনাট্য "জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে" বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন কামাল লোহানী। এই সময় তিনি আবৃত্তি ও উপস্থাপনায়ও যুক্ত করেন নিজেকে। ১৯৬৭ সালে যখন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পার্লামেন্টে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে খাটো করে বক্তব্য দেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে কটুক্তি করে “তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির কেউ নন” উচ্চারণ করলে তখন পুর্ব বাংলা ফুঁসে ওঠে। আপোষহীন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী ‘ক্রান্তি’র জরুরি সভা ডেকে প্রতিবাদ করলেন, এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রেজোল্যুশন পাঠালেন। সেই রেজোল্যুশন থেকেই অত্যন্ত সাহসের সাথে সামরিক শাসনের মাঝেও ডেইলি অবজারভারের নিউজ এডিটর এ বি এম মুসা নিউজ করলেন ‘জবমরসবহঃধঃরড়হ ড়ভ ঈঁষঃঁৎব’। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে শুরুহল যুথবদ্ধ আন্দোলন ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ’ নামে যার আহবায়ক হলেন ওয়াহিদুল হক ও কামাল লোহানী। পরিষদ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্র অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছিল এবং বিপুল দর্শক সমাগমে উর্দূভাষী গুন্ডাদের হামলার পরেও অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল।
১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী উত্তাল সময়ে তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'স্বরাজ' পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি জওয়ানদের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তাঁর রচিত প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য যা স্বরাজে প্রকাশিত হয় “বিদ্রোহ ন্যায়সংগত” ব্যানার হেড লাইনে। এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে 'বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ' গঠনে তৎপর ছিলেন।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর অবস্থার অবনতিতে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমান্তে পৌঁছেন এবং ঐ স্থানের থানা হাজতে নিরাপদে রাত কাটানোর পরের দিন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গিয়ে উপস্থিত হন।
আগরতলা থেকে কামাল লোহানী অন্যদের সাথে ট্রেনযোগে কলকাতা যান। যাত্রাসঙ্গী প্রখ্যাত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের আত্মীয়ের আমহার্ষ্ট স্ট্রীটের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে থেকেই কামাল লোহনী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সূত্র খুঁজতে থাকেন। এমন সময় তাঁর সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী তাঁকে 'জয়বাংলা' পত্রিকায় নিয়ে যান। ঐখানে কাজ করতে করতে তাঁর সাথে আমিনুল হক বাদশার দেখা হয় বাংলাদেশ মিশনের সামনে।
আমিনুল হক বাদশা অনেকটা 'হাইজ্যাক' করার মতো তাঁকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে যান বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'-এর ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। বালীগঞ্জের এই বাড়িটিতে মন্ত্রীরা (অর্থাৎ প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীরা) বাস করতেন। তাঁরা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। এইখানেই প্রচলিত রীতির যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও ব্যবস্থা না থাকা সত্তে¡ও এই শক্তিধর ট্রান্সমিশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। সংবাদ বিভাগ সংগঠন করা ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, শ্লোগান দেয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন তিনি এবং বিশ্ববাসীর কাছে সেই বিজয় বার্তা পৌঁছেছিল কামাল লোহানীর উচ্চারণে।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার যখন ঢাকায় আসে তখনো তিনি ঢাকায় এসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারা বিবরণী পাঠ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বেতারের দায়িত্ব¡ নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে ব্রতী হন তিনি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী এবং আশফাকুর রহমান খান।
দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নিরব প্রতিবাদেই বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে তিনি বেতার ত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন 'দৈনিক জনপদ' নামে একটি নতুন পত্রিকায়। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন।
১৯৭৪ সালে 'দৈনিক জনপদ' ছেড়ে 'দৈনিক বঙ্গবার্তা'য় যোগ দান করেন। মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। প্রায় তিনমাস পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কামাল লোহানী 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে কামাল লোহানী সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আবেদ খান রচিত 'জ্বালামুখ' নাটক পরিচালনা ও নিপীড়নে বিধ্বস্ত এক মানুষের চরিত্রে অভিনয়ও করেন। এবছরই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরী ও চেকোশ্লোভাকিয়া সফর করেন।
সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র এ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগ দানে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় চাকুরিহারা কামাল লোহানী খুবই অর্থকষ্টে পড়েন।
১৯৭৭ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার রাজশাহী থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক বার্তা'র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন তাঁকে। ১৯৭৮ সালে তাঁকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্পাদক হবার পর জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা-তে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাস্ট্রপ্রধান সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সম্পাদক হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু রাস্ট্রপতির সামরিক সচিবের প্রস্তাবানুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করায় সামরিক সচিবের সাথে বাকবিতন্ডা হয় এবং তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিহার করেন।
১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে 'দৈনিক বার্তা' ছেড়ে 'বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট' এর প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথ নিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক'মাস পরেই তিনি পিআইবি'র এসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।
১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। কিন্তু পিআইবি'র মহাপরিচালক তাঁকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠান। এই সময় রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি যুক্ত হলো সংস্কৃতি সংগ্রাম। কামাল লোহানী ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আবারও দু’বছরের জন্যে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পঞ্চাশের দশক থেকেই তিনি আবৃত্তি স্বত্বায় পরিচিত হতে শুরু করেন। সে সময়ের অনুষ্ঠান সংগঠক, ধারা ভাষ্যকার বদরুল হাসানের নজরে পড়েন তিনি। তাঁরই প্ররোচনায় কামাল লোহানী গ্রন্থনা, আবৃত্তি ও বিবরণী পাঠে আরো বেশি যুক্ত হয়ে পড়েন যা তাঁকে পুর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক চর্চায় প্রতিষ্ঠিত করে এবং তিনি সুদীর্ঘকাল দাপটের সাথে এই ক্ষেত্রে বিচরণ করেন।
কামাল লোহানী ’৭২ এর সংবিধান পুণঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একুশের চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন। সবকিছুর পাশাপাশি কামাল লোহানী 'আমার বাংলা' নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করেছেন। তিনি দেশের বৃহত্তম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’- এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আমৃত্যু এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থকেছেন।
তাঁর লেখা ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’ এবং ‘লড়াইয়ের গান’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশিত তাঁর লেখা নিয়ে ‘সত্যি কথা বলতে কি’ এবং কবিতার বই ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশ পায় ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’ ও ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’ বই দুটি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবী, এর প্রাসঙ্গিকতা, ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নিজের লেখার সংকলন ‘শত্রু বধের উৎসবে’ এবং বরণীয় ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে নিজের লেখার সংকলন ‘যেন ভুলে না যাই’ প্রকাশিত হয়।
বাংলা একাডেমি ফেলো কামাল লোহানী জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছেন ২০০৮ সালে। কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি ১৯৯১ সালে। প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা পান তিনি। এ ছাড়া ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ক্রান্তি স্মারক- ২০০৩, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারকসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা তাঁর মিলেছে। একুশে পদক পেয়েছেন।
কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যা। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং পেশায় পুত্র সাগর লোহানী সাংবাদিকতা এবং চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত, জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকুরীর পাশাপাশি “শ্রুতিনন্দন কলা কেন্দ্র” পরিচালনা করছেন এবং কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানী দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জীবন ও কর্মের অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন ডট কম পরিচালনায় সম্পৃক্ত।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: